গাছে ফুল ফোটে আবার ঝরে পড়ে। কেউ তাদের খোঁজ রাখে না। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন একটি কুসুম কোরক বিকশিত হয় যে তার সুগন্ধে কানন আমোদিত হয়ে ওঠে। তার পাশে এসে গুণ গুণ করে মৌমাছি তাকে জানায় স্বাগত সম্ভাষণ। সৌন্দর্য্য পিয়াসী মানব তার দর্শনে নয়নতৃপ্ত করার জন্য তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেই কুসুম যখন ঝ'রে পড়ে তখন তার জন্য বেদনাবোধ স্বাভাবিক এবং চিরন্তন। এমনি একটি কুসুম বাংলার কাননে সুদীর্ঘকাল সুগন্ধ বিতরণ ক'রে ২১শে জ্যৈষ্ঠ তারিখে ঝ'রে গেল বৃম্ভ হতে। মদনমোহন সাহা রওনা হলেন অমর লোকের পথে। বিরাট মহীরুহ যখন অঙ্কুরিত হয় তখন যেমন কেউ চিন্তে পারেনা তার অন্তর্নিহিত স্বত্তাকে, তেমনি যখন ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার কালীপুর গ্রামের দরিদ্র পদ্মলোচনের গৃহে কুজাসুন্দরীর গর্ভে ১২৮৭ সালের ২৫শে জ্যৈষ্ঠ তারিখে যে নবজাতক জন্মগ্রহণ করে তাকেও সেদিন কেউ চিন্তে পারেনি। পদ্মলোচন সাহার দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ গুরুদয়াল এবং কনিষ্ঠ মদনমোহন। মদনমোহনের বয়স যখন ৫।৭ বৎসর তখন তাহার পিতা এবং মাতা অতি-অল্পকালের ব্যবধানে পরলোকগমন করেন। সংসারে অনভিজ্ঞ বালক মদনমোহন মাতৃপিতৃহীন হইয়া চারিদিক অন্ধকার দেখেন। এমন সময় তাহাদের স্নেহপরায়না পিসীমাতা তাহাদের দুই ভাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁহারও আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিলনা। নানারূপ কায়িক পরিশ্রম করিয়া তিনি দুই ভ্রাতুষ্পুত্রসহ কালাতিপাত করেন। অতি শৈশব হইতেই মদন- মোহনের লেখাপড়ার প্রতি আকুল আগ্রহ ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য- বশতঃ আর্থিক অনটনের দরুণ তাঁহার বিদ্যা পাঠশালার গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই জন্য পরবর্তী জীবনে তিনি দুঃখ করিয়া বলিতেন যে "যদি লেখাপড়া জানিতাম তবে আরও উন্নতি করিতে পারিতাম।” তিনি নিজে লেখাপড়া না জানিলেও লেখাপড়ার প্রতি তাহার আকুল আগ্রহ ছিল। এজন্য তিনি নিয়মিতভাবে বহু দরিদ্র মেধাবী ছাত্রকে আর্থিক সাহায্য করিতেন এবং লেখাপড়ায় সকলকেই প্রচুর উৎসাহ দিতেন। মাত্র ১২।১৩ বৎসর বয়সে তিনি সংসারের আর্থিক কষ্ট দূর করিবার জন্য সামান্য বেতনে চাকরী গ্রহণ করেন। সেখানে কোন উন্নতির সম্ভাবনা না দেখিয়া সামান্য পাথেয় লইয়া কলিকাতায় আসেন এবং তাঁহার এক বন্ধুর সাহায্যে সামান্য বেতনে চাকরী গ্রহণ করেন। পরে সে কাজ বন্ধ হইয়া যাওয়ায় সন ১৩১৫ সালে করগেট টীনের দালালী আরম্ভ করেন। মদনমোহন কলিকাতায় আসিয়া কঠোর পরিশ্রম করিতে লাগিলেন এবং তাহার কার্য্যদক্ষতা ও অধ্যবসায়ের গুণে বহু লোকের প্রিয়ভাজন হইয়াছিলেন। দালালী কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজ নামে বহু আফিস হইতে করগেট-টীন খরিদ করিয়া কেনা বেচা করেন। অনুমান ২৭/২৮ বৎসর বয়সে কালীপুর গ্রামের শ্রীযুক্ত প্যারীমোহন সাহার তৃতীয়া কন্যা শ্রীমতি বিধুমুখীর সহিত তাহার বিবাহ হয়। কিছু দিন কাজ করার পর তিনি কলিকাতায় বাসা ভাড়া করিয়া দেশ হইতে পরিবার কলিকাতায় লইয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহার অচল অধ্যবসায় ও ব্যবসায়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধির গুণে অতি শীঘ্রই তিনি ব্যবসায়ে উন্নতি লাভ করেন এবং ডেভিড সেসন এণ্ড কোংর বেনিয়ান হন। তিনি গিবন এণ্ড কোম্পানী, ডরম্যান লং এণ্ড কোং লিমিটেড, আয়রণ সাইড লিমিটেড প্রভৃতি বহু বিলাতী কোম্পানীর টিন কেনাবেচা করিয়াছেন এবং পরে ভারত বিখ্যাত টাটা আয়রণ এণ্ড ষ্টীল কোং লিমিটেডের রেজিষ্টার্ড ডিস্টিবিউটর এবং ভারত গভর্ণমেন্টের ষ্টকিষ্ট নিযুক্ত হইয়াছিলেন। কৰ্ম্মই তাঁহার জীবনে মূলমন্ত্র ছিল। দেবদ্বিজের প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় ভক্তি ছিল। নিজের ব্যবসা ছাড়াও বহু লোককে ব্যবসা করিতে অর্থ সাহায্য করিয়াছিলেন। যদিও তাহাতে নিজে বিশেষ লাভবান হন নাই, কিন্তু নিজের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সততার গুণে করগেট টানের ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থোপার্জন করিয়াছেন এবং বহু লোকের প্রিয়ভাজন হইয়াছিলেন। তিনি যেমন একদিকে প্রচুর অর্থোপার্জন করিতেন অন্যদিকে তেমনি দরিদ্রনারায়ণের সেবায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করিতেন। ধর্ম্মে তাঁহার অচল বিশ্বাস ছিল। বহু দুস্থ পরিবার তাঁহার নিকট হইতে নিয়মিত অর্থ সাহায্য পাইতেন। প্রচুর ধনের অধিকারী হইয়াও তিনি শেষজীবন পর্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন। ১৯৪৪ সালের ৭ই নভেম্বর তাঁহার সতীসাধ্বী স্ত্রী শ্রীমতী বিধুমুখী মারা যান। আজ তিনি নাই। তাঁর আত্মা অমর লোকে চলিয়া গিয়াছে। তাঁহার আত্মার কল্যাণ হউক ইহাই কামনা করি। ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি !! ওঁ শান্তি !!!